নাজমা খাতুন :: যুগের চাকায় তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিও গড়িয়ে গেছে বহু দূর। চলচ্চিত্র জগতে কত শিল্পী এসেছেন ও কত শিল্পী বিদায় নিয়েছেন। কত ঘটনা রয়ে গেছে ইতিহাস হয়ে, আবার কত কথা কখনো কেউ জানতেও পারেনি। ক্যামেরা থেকে শুরু করে বদলেছে চলচ্চিত্রের ধরন। সেযুগের থেকে এযুগের প্রযুক্তি অনেকটা উন্নত।


প্রযুক্তি: সেকালের শুটিং ক্যামেরা থেকে একালের শুটিং ক্যামেরা বহু উন্নত। ম্যাজিক লন্ঠন থেকে রিল এবং রিল থেকে ছবি বন্দী হয়েছে মেমোরিতে। নির্বাক চলচ্চিত্রে হঠাৎ একদিন বেজে ওঠে শুরের ঝঙ্কার, যা কিনা শুটিংয়ের সময় গোপন মাইকে রেকর্ড করা হতো। তাও এখন বন্দী এক চার দেয়ালের সাউন্ড সিস্টেম রুমে। দর্শকের নজর কাড়তে রূপলী পর্দায় ছেটানো হয়েছে সোনালি রং। উন্নত মানের ছবি তৈরি করতে এ তালিকায় যোগ হয়েছে নানার ধরনের লাইট, ক্যামেরা, ট্রলি, জিমি, স্টুডিও সহ নানান উন্নত মনের মেশিন। স্টুডিওর ছবিকে আরো সত্যি প্রমাণ করতে এসেছে গ্রীন স্ক্রীন, VFX। রিলবন্দি ছবি মেমোরিতে আসায় কাঁচি জায়গা নিয়েছে মুঠবন্দি মাউস।
কিন্তু তার সত্ত্বেও সে সময়কেই চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা হয়। তার কারণ? কি ছিল সেই সময় যা আজ নেই ? আজ প্রযুক্তির এমন অভাবনীয় উন্নতির পরেও কেন স্বর্ণযুগের শিখরের ধারে কাছেও নেই বর্তমান চলচ্চিত্র শিল্প? বহু আলোচিত এই বিষয়েই আজকের এই বিশ্লেষণাত্বক প্রতিবেদন।

পরিচালনা: বলা যায় চলচ্চিত্রের মূল স্তম্ভই হল পরিচালনা। তৎকালীন সময়ে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, অজয় কর প্রমুখের মতো পরিচালকেরা কাজ করেছেন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তাদের অন্যতম হাতিয়ার ছিল অনন্যতা। ‘নায়ক’ সিনেমার স্বপ্ন দৃশ্য হোক, কি ‘সপ্তপদী’ র ওথেলোর নাট্যদৃশ্য। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এর knife Throwing এর দৃশ্য বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ য় নীরার মৃত্যুদৃশ্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপাত কঠিন দৃশ্যগুলিকে কত সহজ ও সাবলীলভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে সেটা ডিজিটাল যুগ নয়। প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করেই তারা অমন কালজয়ী সিনেমা দর্শককুল কে উপহার দিয়েছেন।
কিন্তু বর্তমান সময়ে দক্ষতা, প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতার অভাব না থাকলেও Uniqueness বা বাঁধা ধরা গন্ডির বাইরে গিয়ে কিছু করার প্রচেষ্টা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিছু কিছু সিনেমা মনে দাগ কাটলেও তা সংখ্যায় নগণ্য।


অভিনয়: পরিচালনা যদি সিনেমার মস্তিস্ক হয় তবে অভিনয় নিঃসন্দেহে সিনেমার হৃৎপিণ্ড। একটি সিনেমার মান তার চিত্রনাট্যের উপর যতটা নির্ভর করে, ঠিক ততটাই নির্ভর করে অভিনেতাদের দক্ষতার উপর। তুলনামূলক দূর্বল চিত্রনাট্যকেও নিজ অভিনয়গুণে পর্দায় সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেযুগের অভিনেতা-অভিনেত্রী রা। উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় – নাম লিখতে বসলে প্রতিবেদনের আকার মহাভারতের ন্যায় হয়ে যাবে। শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রই নয়, পার্শ্বচরিত্রেও এঁদের অভিনয় কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। যা একটি সিনেমাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম।
অপরদিকে বর্তমানে বহু শক্তিশালী অভিনেতা রয়েছেন। কিন্তু নিজস্ব ইমেজ, ব্যবসা ইত্যাদি যেকোনো কারণেই হোক তারা নিজেদের Comfort Zone থেকে বেরিয়ে আস্তে নারাজ। ফলে বহু প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পরপর প্রায় একই ধরণের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। বৈচিত্র্য না থাকায় সিনেমাগুলি দর্শকের মনের মনিকোঠায় বিশেষ জায়গা করে নিতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি অভিনয়ও রীতিমতো দৃষ্টিকটু।


গান: সেযুগে সিনেমায় গানের একটি বিশেষ অবদান ছিল। পরিচালনা, অভিনয়ের পাশাপাশি গান সিনেমাটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যেত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত – প্রমুখের কণ্ঠের জাদুতে সৃষ্ট কালজয়ী গানগুলি চিরকাল বাঙালীর হৃদয়বীণায় অনুরণিত হতে থাকবে। যেমন ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’– বাঙালীর রোমান্টিসিজমের চিরন্তন প্রতীক, ঠিক তেমনি ‘বিপিন বাবুর কারণসুধা’ – ছিল বাঙালী মাতালদের জাতীয় সঙ্গীত। সুর ও কথার চমৎকার সংমিশ্রনে তৈরী হওয়া গানগুলি আজও বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী।
অপরপক্ষে বর্তমান সময়েও যথেষ্ট সুদক্ষ সুরকার ও গায়ক আছেন। কিছু কিছু গান অসাধারণ হলেও বেশিরভাগই কালের স্রোতে হারিয়ে যায়। সিনেমায় গান রাখতেই হবে এই প্রবণতা থেকে বহু অপ্রাসঙ্গিক গানের জন্ম হয়। সৃষ্ট হওয়া গানগুলি যে শুধু অপ্রাসঙ্গিক তাই নয় গানের কথা-সুর দর্শককুলের হৃদয়ঙ্গম হয় না। তাই সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তীতে গানগুলি দর্শক মন থেকে ধীরে ধীরে চিরতরে মুছে যায়।

সাহিত্য নির্ভরতা: এসকল উর্ধ্বে যা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ত হলো সাহিত্য নির্ভরতা। স্বর্ণযুগের অধিকাংশ সিনেমাই ছিল মূলত সাহিত্য নির্ভর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ – প্রমুখের রচিত বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস কে ভিত্তি করে গড়ে উঠতো সিনেমার চিত্রনাট্য। ফলে সিনেমাটি একটি নির্দিষ্ট গতি সহকারে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে পরিণতির দিকে এগিয়ে যেত, এবং কাহিনীকার একজন অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক হওয়ায় কাহিনীর ভিত্তিও ছিল মজবুত। ফলে সিনেমার কনটেন্ট ও পোক্ত হত।
কিন্তু বর্তমানে সাহিত্য নির্ভরতা দিনে দিনে কমে আসছে। পরিচালকগণ স্বয়ং কাহিনীকার হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিণত ও অদক্ষ লেখনীর জন্য সিনেমার কনটেন্ট মজবুত হচ্ছে না। এমন নয় যে সকলের ছবির মান খারাপ বা সত্যতা নেই। যেসকল পরিচালক সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিনেমা গড়ে তুলছেন, নানান রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে আটকে দেওয়া হচ্ছে তাদের ছবির সেন্সর। এবং যতক্ষণ না তা থেকে সে সকল বাদ দেওয়া হচ্ছে বা পরিবর্তন করা হচ্ছে তখনই তা পড়ে থাকছে তাদের বাড়ির পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে। যা অবশ্যই সিনেমার মান কমে যাওয়া একটি প্রত্যক্ষ কারণ।