নিজস্ব প্রতিবেদন : আন্দ্রেই তারকোভস্কির বাবা ছিলেন কবি। তাঁর কবিতায় শান্ত ধীর এক অধ্যাত্মবাদ টের পাওয়া যায়। তারকোভস্কির সিনেমায় তিনি নানাভাবে ফিরে আসেন। আকিরা কুরোসাওয়ার বাবা ছিলেন কঠিন শাসক। শিশু আকিরাকে উঠতে হতো অতি ভোরে, সকল ঋতুতে, আমাদের রবীন্দ্রনাথের মতন। শিশু আকিরা স্বীকার করেছিলেন আত্মজীবনীতে, শৈশবে তাঁর বুদ্ধি বিকাশের দেরির কথা। এমন বিকশিত হলেন তিনি পরে, সারা পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আকিরা কুরোসাওয়া, জাপানী সিনেমার রাজাধিরাজ, একদিক থেকে ভেবে দেখতে গেলে, তিনি সেই অর্থে নিছক সিনেমা বানানোর চক্করে ছিলেন না। এমনকি যখন সত্যতর অর্থে, শ্যুটিং প্রস্তুতির জন্যে টাকাপয়সার টানাটানিতে পড়তেন তিনি, ভবিষ্যতে নির্মাণের জন্যে সিনেমার প্রস্তুতি নিতেন— প্রতিটি ডিটেলের কথা নিখুঁতভাবে চিন্তা করে। ক্রিটিক এবং জাপানী সিনেমার ইতিহাসবেত্তা ডোনাল্ড রিচি ‘পরিচালকের স্মরণে’ শীর্ষক এক রচনায় জাপানী চলচ্চিত্রের সংজ্ঞায়নে অন্য যে কারো চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন কুরোসাওয়ার ‘পণ্যটিকে নিঁখুত করবার ভাবনা’ কথাটির উপর। “যদিও অনেক চলচ্চিত্র সংস্থা-ই নির্মাতার এমন আত্মনিবেদনে আলোকিত হয়ে উঠত”, রিচি লিখছেন, “জাপানী স্টুডিওগুলো প্রায়ই ইনোভেশনের চেয়ে সহযোগিতায় অধিকতর মুগ্ধ হয়।” কুরোসাওয়ার পক্ষে, তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রাপথে, উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টের জন্য টাকাপয়সা সংগ্রহ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। রিচি সত্তর দশকের এক সময়ের কথা স্মরণ করে লিখছেন, “তিনি বুঝেছিলেন কাগেমুশা সত্যিকারের আলোর মুখ দেখবে না। কুরোসাওয়া সময় কাটাচ্ছিলেন প্রতিটি দৃশ্য এঁকে, তিনি অন্য কোনো কোনো পরিচালকের মতো স্টোরিবোর্ড ব্যবহার করতেন। এখন সেসব গ্যালারির প্রশস্ততাকে উজ্জ্বল করছে— অনির্মিত মাস্টারপিসের প্রদর্শনকক্ষ।” সিনেমা নির্মাণ করতে না পারলে ডিটেলগুলো লিখতেন, তারপর সেসব এঁকে নিজে-নিজে বুঝতে চাইতেন।

“আমার উদ্দেশ্য ভালো মতো পেইন্ট করা ছিল না। নানা পদ্ধতি নিয়ে দ্বিধাহীন খেলতে চেয়েছিলাম আমি।” কিন্তু আপনারা যেমন দেখতে পাচ্ছেন, সম্রাট জানতেন তিনি কী চান— সুনির্দিষ্ট শটটা অনেক আগেই স্পষ্টভাবে তাঁর দৃশ্যকল্পনায়, তাঁর প্রচুর সময় ও শক্তি খরচের বিষয়টা রিপ্রেজেন্ট করত। মাঝে মধ্যে, কুরোসাওয়ার নিজের আর্টওয়ার্ক অপেক্ষাকৃত কম-পরিচিত সিনেমার (কুরোসাওয়ার বিশাল কাজের প্রেক্ষিতে) অফিশিয়াল পোস্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো; ব্যক্তিগত কাজ, যেমন সত্তর দশকের ‘ডোডেসকাদেন’ কিংবা শেষ কাজ, ১৯৯৩-এর ‘ম্যাদাদেও’। আমরা নথিভুক্ত করতে পারি চলচ্চিত্র পরিচালকের চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ— এবং হয়তো ফিল্ম নির্মাণে, বেশিরভাগটাই তাঁর বড় ভাই হেইগোর প্রভাব। নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন সজীব ধারাভাষ্যকার এবং প্রলেতারিয়ান আর্টিস্ট লীগের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হেইগো, ১৯৩৩ সালে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস ভঙ্গ ও নিজের কেরিয়ার বিধ্বংসী সবাক চলচ্চিত্রের আবির্ভাবের দরুণ আত্মহত্যা করেন। তরুণ আকিরার পরিচালনা শুরু তার এক দশক পরে। এরপর পঞ্চান্ন বছর ধরে ধারাবাহিক থাকবেন তিনি পরিচালনায়। আমরা নিশ্চিত জানি, সকল সম্ভাব্য স্তরেই হেইগো ছোটো ভাইয়ের জন্য গর্বিত হতেন। ‘সানশিরো সুগাতা’— আকিরা কুরোসাওয়ার প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তির বছর উনিশশো তেতাল্লিশ। যুদ্ধকালীন সময়ে বিনোদনের(!) দরকার মেটানোর জন্যে ফেলে দেওয়া হয় এক হাজার আটশো পয়তাল্লিশ ফিট ফিল্ম! তারপর রি-রিলিজ করে এপ্রিলে, বাহান্ন সালে— পয়তাল্লিশ সালে সরকারের অনুরোধে একই নামে সিক্যুয়েল করেন। দুটো সিনেমাই দেখেছিলাম এক রাত জেগে। মূল চরিত্রে ছিলেন ডেনজিরো ওকুচি। (নিকুচি করেছে, এত ভালো অভিনয় কেন করলি বে!— লিখেছিলাম তখনকার দিনপঞ্জিতে) একজন দক্ষ জুডো অনুশীলনকারীর চরিত্রে ছিলেন ওকুচি, যিনি কিনা পরিণত হতে হতে বোঝেন, বুঝতে পারেন— একটা ‘রিজন’ ছাড়া যুদ্ধ কেন! সেকেন্ড পার্টে দুর্দান্ত সমালোচনা আছে বক্সিং-এর; যাকে আকিরা দেখিয়েছেন আমেরিকান এক হিংস্র খেলা হিসেবে। দুটো ছবিই আমাদের শেখায় যে, আমাদের এই দীন-হীন, জীর্ণ জীবনেও কিছু শমিত থাকার দরকার হয়, কিছু সংযম অপরিহার্য হয়। আসলে একটা ব্যাপার ভেবে দেখলাম, আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রেড বিয়ার্ড’ দেখার আগের মানুষ আর পরের মানুষ এক থাকতে পারে না। সত্যি বলতে কী, সর্বহারা আর সর্বস্বহারাতে সব সময় একটা মৌলিক ফারাক থেকে যাবে। সাধে তো আর মার্কেজ ছয়বার দেখেননি ফিল্মটা! আমি অটোয়োর প্রেমে পড়লাম। মনে হল, এমন একটা সর্বস্বহারা মমতাময় নারী আমার জীবনে এলে তাঁকে কখনো কাঁদতে দিতাম না।

তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষের হাতে টাকা ফুরিয়ে আসছে আর প্রথম বিশ্বের জেফ বেজোসদের কিংবা তৃতীয় বিশ্বেরই ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে রাখা টাকায় ছত্রাকের ঘরসংসার। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দরিদ্র প্রেমিকজুটির কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল আকিরা কুরোশাওয়ার ‘ওয়ান ওয়ান্ডারফুল সানডে’। যতবার এই অংশটা দেখি, চোখের জলে ভাসি। মেয়েটি যখন শূন্য অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে বলে— “আমরা যারা গরিব জুটি আমাদের জন্য দয়া করে হাততালি দিন। এই ঠান্ডা বাতাস যাতে আপনাদের হৃদয়ের উষ্ণতায় দূর হয়ে যায়।” পরমাণবিক ঝুঁকির যে বিশ্ব যুদ্ধোন্মাদ দেশগুলো ফলিয়ে তুলেছে তার মধ্যেই তো নির্মাতা কুরোসাওয়ার বেড়ে ওঠা। বেড়ে ওঠাটুকুর মধ্যে অন্তর্লীন সবটুকু বিপন্নতা, অস্বস্তিজনিত প্রতিরোধ সব আমরা দেখে উঠব ‘আই লিভ ইন ফিয়ার’ চলচ্চিত্রে। এখানে একজন মানুষ সবসময় ভাবেন, যে কোনো সময় একটা পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হবে, সে ভয়েই সন্ত্রস্ত তাঁর জীবন। কিন্তু শুধু ভয়ের কথা নয়, ভয়কে জয় করার কথাও আছে তাঁর সিনেমায়। এখন উত্তরসত্য নিয়ে নানা মতবাদিক চাপানউতোর চলছে। সে-ই কবে সত্যের বহুকৌণিকতা দেখিয়েছিলেন কুরোসাওয়া ‘রসোমন’ ছবিতে। বলুন তো, প্রকৃত স্পর্ধা, বিপ্লবী ঔদ্ধত্য আর অবিকল্প প্রেম নিয়ে তোশিরো মিফুনেকে আর কোথায় দেখেছি আমরা! সামুরাই যুদ্ধ করে প্রাণপণ কিন্তু সে-ও তো ক্লান্ত হয়। সে ক্লান্তি সিনেমার ধ্রুপদী দৃশ্য। চিত্রকর কুরোশাওয়া বেছে নিয়েছিলেন মর্ত্যপৃথিবীর নিয়মরহিত শিল্পসাধক ভ্যান গগকে, ‘ড্রিমস’, চিত্রকলার প্রতি কুরোসাওয়ার চিরন্তন প্রেমেরই উদযাপন৷