মনামী রায় : ডিসেম্বরের শুরুর দিক, শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। হাওড়া শিবপুরের বাজারের একদম শেষ প্রান্তে লাইমলাইটের থেকে দূরে বার্ধক্যে মলিন হয়ে একা নির্বাসন কাটাচ্ছেন কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথ। শীতের এক সকালে হঠাৎই তাঁর বাড়িতে হাজির হয় ”key খবরে”র টিম। বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই শ্রদ্ধায় এবং অদ্ভু খারাপ লাগায় মনটা ভারী হয়ে উঠল। তারপর আসতে আসতে তাঁর ঘরে ঘুরে দেখতে দেখতে চোখে পড়লো , অবিকৃত একটি বেশ পুরোনো টেবিল ল্যাম্পে ।

এই ল্যাম্পটি জেলেই নারায়ণ বাবু তাঁর হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টেকে তৈরি করেছিলেন। টেবিলের আরেক পাশে রাখা রয়েছে কিছু রং-তুলি। রংয়ের শিশি গুলোয় রং প্রায় শুকিয়ে এসেছে। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খালি পাতা গুলো। তাদের শিল্পীর তুলির টান আবার কবে তাদের রাঙিয়ে তুলবে সেই প্রশ্ন নিয়ে। দেওয়ালে ঝুলছে অসংখ্য পুরস্কার পাশেই একটি কাঁচের আলমারিতেও ভর্তি তাঁর প্রাপ্য সম্মানে। আবার কোথাও ঝুলছে তাঁরই আঁকা কোন ছবি। পুরোনো কিন্তু ঐতিহ্যবাহী ওই ঘরটার সেলিং থেকে ঝুলছে আরও একটি আলো।

সেই ঘরটার আনাচে কানাচে রাখা জিনিসগুলোকে ক্যামেরা বন্দি করেছিলেন ”key খবরে”রই চিত্র সাংবাদিক অমিত মুন্সী। বেশ খানিক্ষন অপেক্ষার পরে দেখা মিলল সেই জীবন্ত কিংবদন্তির। বয়সের ভারে উঠতে পারেননা তিনি। হাসতে প্রায় ভুলেই গেছেন এই কার্টুন স্রষ্টা। তাঁকে প্রথমে যখন প্রশ্ন করলাম উত্তর দেননি তিনি। কিছুটা অভিমানে কিছুটা বয়েসের কারণে তিনি কথা বলতে চাইছেন না। তারপরে নিজেই বললেন উঠে বসতে চান তিনি। অপেক্ষা করলাম আরও কিছুক্ষন তাঁর মুখে দুটো একটা কথা শুনবো বলে। তারপরে গল্প চললো বেশ কয়েক মিনিট। কারোর কথা শুনতেও বেশ বেগ পেতে হয় তাঁকে। একটু গলার স্বর বাড়িয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলাম কেমন আছেন ? উত্তরে খুব ধীরে কানে এলো ”ভালোই”। এই প্রশ্ন উত্তরের মধ্যেই বেশ ক্ষোভ করে জানিয়ে ছিলেন ” আগে অনেকে আসতো এখন আর কেউ আসেনা। সবাই বোধ হয় ভুলেই গেছে”। তাঁকে জানিয়েছিলাম না তাঁকে কেউ ভোলেনি। তাঁর তৈরী হাঁদা -ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে দিয়েই তৈরী হয়ে বাচ্ছাদের ছেলেবেলা।

সেই ক্ষোভ বোধহয় শেষ বয়সে কিছুটা হলেও কম করতে পেরেছিলাম আমরা। আমাদের খবর তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল আরও সংবাদমাধ্যমকে। আমাদের খবরের জেরেই ছুটে এসেছিলেন খোদ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর । যখন প্রথম নারায়ন বাবুর বাড়ি গিয়ে কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে তাঁরা জানিয়েছিল – ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে জানা গিয়েছিল নারায়ন দেবনাথ পদ্মশ্রী পাচ্ছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে বলা হয়েছিল পরিবারের যেকোন দুজন এসে নিয়ে নিয়ে যেতে পারে নারায়ণ বাবুর পুরস্কার। তারপরে দিল্লী যাওয়ার জন্য টিকিট কাটা হয়ে গেলেও যাওয়া আর হয়নি কারণ সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়ে ছিল পুরস্কার তাঁর হাতে তাঁর বাড়িতেই তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। সেই আক্ষেপও মনের কোণে বাসা বেঁধেছিল।

আমরা যখন নারায়ন বাবুর পুত্রবধূর সঙ্গে কথা বলেছিলাম তিনি গলায় আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন ” আমরা চাই মানুষটা নিজের প্রাপ্য পুরস্কারটা দেখে যেতে পারুক”। আমরাও তেমনটাই চেয়েছিলাম। ”key খবরে”র মাধ্যমে জানানো হয়েছিল তাঁর ইচ্ছের কথা।

মাত্র কয়েকদিন আগের কথা হঠাৎ জানতে পারলাম তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কথা। তাঁর বাড়িতে ফোন করা হলে তাঁর পুত্রবধূ জানান, তাঁর শরীর খারাপ। বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি। এক নিমেষে চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎকার। অনেকদিন পর তাঁর খোঁজ নিতে কেউ এসেছে বলে তাঁর ঠোঁটের কোনায় সেই সিন্গ্ধ হাসি। তিনি যোদ্ধা, নিজে লড়াই করে নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন।

নির্দ্বিধায় দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর তৈরী সমস্ত সৃষ্টিকে। শেষ বয়সে তাঁর কাছে ছিলনা তাঁরই তৈরী কোনো কমিক্সের অরিজিনাল কপি। ভেবেছিলাম হাসপাতাল থেকে যুদ্ধ করেই আবার ফিরবেন। তেমনটাই হয়তো আশা করেছিল তাঁর প্রিয় ঘরটাও । তবে ফেরা আর হলনা। তিনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন না বলেই। হয়তো শেষ জীবনে মনের কোনে অভিমানটা রয়েই গিয়েছিল।