গ্রীন হাইড্রোজেনে নবযুগান্তর
মাধবদাস সৌগত দত্ত , রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জ্বালানী ছাড়া জীবন যেন স্তব্ধ ,অচল হয়ে যায় এক নিমেষে । আর এদিকে প্রকৃতির গর্ভে মজুত থাকা সহজলভ্য জীবাস্ম জ্বালানীর ভান্ডার সভ্যতার চাহিদা পুরণে যথাযত নয় । তাই বিশ্বরাজনীতিতে খনিজ তেলের প্রভাব আর রাজ্য-রাজনীতিতে পেট্রোলের প্রভাব ক্রমশ বেড়েই চলেছে । এমনিতেই ভারতে এই মুহূর্তে প্রতি রাজ্যে পেট্রোলের গড় দাম ১০০ টাকার কাছাকাছি যার জন্য থেকে থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক তরজা দেশের অভ্যন্তরে দেখা যায় । যদিও কোনো কারণেই পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিকে উপেক্ষা করা যায় না । আবার অন্যদিকে ভারতে খনিজ তেলের ভান্ডার কম থাকায় আন্তর্জাতিক স্তরেও কম কূটনৈতিক চাপে পরতে হয়না ভারতকে । সম্প্রতি এই রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের মরশুমে GlobSec 2022 Bratislava Forum- এ আমাদের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে ভারতের রাশিয়া থেকে খনিজ তেল কেনার ব্যপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল । যদিও জয়শঙ্কর মহাশয় কড়া ভাষায় সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলির দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে দিয়েছেন , তবুও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অপ্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যোগানের আরোপ ভারতের উপরে লাগানোর ষড়যন্ত্র ওরা করেছিল ।

এরকম একটা সময়ে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহন ও জাতীয় সড়ক মন্ত্রী নীতিন গডকড়ী মহাশয় একের পর এক যা চমক দিয়ে যাচ্ছেন তা বিরোধীদের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিচ্ছে এবং গোটা বিশ্ব যেন গডকড়ী মহাশয় তথা ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে । গত ৩০ মার্চ গডকড়ী মহাশয় পার্লামেন্টে পৌঁছেছিলেন দেশের প্রথম নির্মিত হাইড্রোজেন চালিত গাড়িতে চেপে এবং গোটা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছিলেন যে ভারত ‘কার্বন ফ্রি ইকোনমি’ -র দিকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে । উপরন্তু গত ৯ জুলাই নাগাদ গডকড়ী মহাশয় আরও একধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেই দিয়েছেন যে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই ভারত বন্ধ করে দিতে চলেছে পেট্রোলের ব্যবহার । সুতোরাং বলা যেতে পারে এখন নবযুগের সম্ভাবনার শিখরে দাঁড়িয়ে ভারত ।

হাইড্রোজেন হচ্ছে এমন একটা মৌল যার পুরো ব্রহ্মান্ড জুড়ে প্রাচুর্য থাকলেও পৃথিবীতে আবদ্ধ আছে বিভিন্ন যৌগের মধ্যে । আর এই যৌগগুলোর মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে সহজলভ্য হল জল । আর তাই এই জল থেকে হাইড্রোজেনকে আলাদা করে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করাই হল আমাদের লক্ষ্য । আমরা সকলেই স্কুলের ভৌতবিজ্ঞান বই – এ ছোটোবেলায় পড়েছিলাম যে জলের তড়িৎবিশ্লেষণে জল থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা হয়ে যায় । আর এই তড়িৎবিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের উৎস যদি সৌরশক্তি , বায়ুশক্তির মতো কিছু পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি হয়ে থাকে তাহলে সেই প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত হাইড্রোজেনকে ‘ গ্রীন হাইড্রোজেন ‘ বলা হয়ে থাকে । হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য আরও বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আছে এবং সেই অনুসারে উৎপন্ন হাইড্রোজেনগুলি ‘ ব্লু হাইড্রোজেন ‘ , ‘ গ্রে হাইড্রোজেন ‘ , ‘ ব্রাউন হাইড্রোজেন ‘ সহ বিভিন্ন নামে পরিচিত । কিন্তু সেগুলো উৎপাদনে কার্বন ডাইঅক্সাইড সহ অন্যান্য গ্যাস নির্গত হয় বলে সেগুলোর উপরে এত নির্ভর করা যায় না । এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তড়িৎবিশ্লেষণের মাধ্যমে হাইড্রোজেন উৎপাদনের মতো প্রক্রিয়াটি এত সহজ জিনিস হওয়া সত্ত্বেও কেন এতদিন পর গ্রীন হাইড্রোজেন জনপ্রিয়তা লাভ করছে ? এর উত্তর হল বিগত দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি গুলির দাম কমেছে । তাই পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তি গুলো নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনাও বদলেছে । সুতরাং এক কথায় ২১ শতকের অন্যতম আশার আলো হয়ে উঠতে চলেছে এই ‘ গ্রীন হাইড্রোজেন ‘ নির্ভর অর্থনীতি । তাই সৌদি আরব , সংযুক্ত আরব আমিরাত , ওমান – এর মতো খনিজ তেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলিও গ্রীন হাইড্রোজেনের প্রতি সচেতন হতে শুরু করেছে । আর অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ইউনাইটেড কিংডম , চিন , জাপানের মতো দেশগুলি তো হাইড্রোজেন জ্বালানীকে জনজীবনের সাথে জুড়তে শুরু করে দিয়েছে । 2021 সালে, অস্ট্রিয়া, চীন, জার্মানি এবং ইতালি সরকারের সমর্থনে, UN শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO) গ্রীন হাইড্রোজেন শিল্পের জন্য তার গ্লোবাল প্রোগ্রাম চালু করেছে । এটি উন্নয়নশীল দেশ এবং পরিবর্তনশীল অর্থনীতির শিল্পে গ্রীন হাইড্রোজেনের ত্বরান্বিত গ্রহণ এবং স্থাপনাকে উদ্দীপিত করে।

এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ এবং বিশ্বের সবথেকে দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারতের শক্তি সম্পদের সুরক্ষা এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল । কারণ ভারত কেবল মুনাফার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে না , ভারত সর্বদা মানবকল্যাণ ও বিশ্বভাতৃত্বের পথ দেখিয়ে এসেছে । ২০২১ এর প্যারিস চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যে ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে অ-জীবাশ্ম জ্বালানী শক্তির ক্ষমতা ৫০০ গিগাওয়াটে উন্নীত করবে । তাই শুধু পেট্রোল বিতর্কে বিরোধীদের যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য নয় , আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতার জন্যও নয় ; মানবসভ্যতার আগামী প্রজন্মের শক্তির উৎসকে সুনিশ্চিত করতে এবং পরিবেশের নির্মলতাকে অখুন্ন রাখতে এই গ্রীণ হাইড্রোজেনের সম্ভাবনাকে এত বেশি প্রাধান্য দিয়েছে বর্তমান ভারত সরকার । গতবছরের অর্থাৎ ২০২১ এর ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ' ন্যাশানাল হাইড্রোজেন মিশন' এর উদঘাটন করেন । চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের শক্তি মন্ত্রালয় দ্বারা ' ন্যাশানাল হাইড্রোজেন মিশন ' এর বিস্তারিত ঘোষণা করা হয় যেখানে ২০৩০ এর মধ্যে ভারতের হাইড্রোজেন উৎপাদন পরিমাণ ৫ মিলিয়ন টন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে এবং হাইড্রোজেন উৎপাদনকারী উদ্যোগপতি ও সংস্থাদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রায় ১০ ধরণের সুবিধা প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে । গত ২৯ এ জুন গ্রীন হাইড্রোজেন নিয়ে নীতি আয়োগের দ্বারা প্রকাশিত একটি বিস্তারিত রিপোর্টে নীতি আয়োগের CEO শ্রী অমিতাভ কান্ত জানান যে সঠিক নীতির প্রেক্ষিতে, ভারত সর্বনিম্ন খরচের উৎপাদক হিসাবে উঠে আসতে পারে এবং 2030 সালের মধ্যে গ্রীন হাইড্রোজেনের দাম প্রতি কেজি US$ 1-এ নামিয়ে আনতে পারে । ইতিমধ্যে রিলায়েন্স , GAIL , NTPC , TATA -এর মতো ভারতের বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলি গ্রীণ হাইড্রোজেনের উপর কাজ করা শুরু করে দিয়েছে । এই প্রসঙ্গে আদানী গ্রুপ ইতিমধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং রিলায়েন্স ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করেছে ।

তবে কোনো কিছুকে অর্জন করতে গেলে যেমন পথে বাধা আসে ঠিক সেরকমই গ্রীন হাইড্রোজেনকে ব্যবসায়িক স্তরে কাজে লাগিয়ে বিপুল জনসাধারণের শক্তির চাহিদা পুরণেও অনেকরকম চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হতে পারে প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে । কারণ হাইড্রোজেন তৈরির প্রক্রিয়ায় ২০ – ৩০% শক্তি নষ্ট হয়। তারপর হাইড্রোজেনকে সংকুচিত করে সংরক্ষণ করতে অন্য 10% হারাতে হয় । অবশেষে, হাইড্রোজেনকে বিদ্যুতে রূপান্তর করার সময় আরও ৩০% হারিয়ে যায়। তাই সব মিলিয়ে এটি ব্যবহৃত মূল শক্তির ৩০ – ৪০ % দেয় । তাই ‘হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল’ -এর সাথে তুলনার বিতর্কে জড়িয়ে আছে ‘ লিথিয়াম আয়ন সেল ‘ । এপ্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত ‘ লিথিয়াম আয়ন সেল ‘ ব্যবহার করে পরিবহন ক্ষেত্রে কার্বণ নির্গমনের পরিমাণকে কমিয়ে এনে নবযুগান্তর আনতে কিছুটা সক্ষম অবশ্যয় হয়েছে ইলন মাস্কের ‘টেসলা ‘ কম্পানি । কিন্তু তা বলে কোনোভাবেই ‘হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ‘ -এর সম্ভাবনা ও গুরুত্বকে খর্ব করা যায় না । কারণ হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল , লিথিয়াম আয়ন সেলের তুলনায় বহুগুণ দ্রুত চার্জ হতে সক্ষম এবং অন্যদিকে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের আয়তন ও ভার লিথিয়াম আয়ন সেলের তুলনায় অনেক কম । তাই হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের ব্যবহার লিথিয়াম আয়ন সেলের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক । এছাড়াও পরিবহণ ক্ষেত্র ছাড়াও হাইড্রোজেনের ব্যপক পরিমাণ চাহিদা রয়েছে স্টিল ও রাসায়নিক সহ বিভিন্ন প্রকার কলকারখানাগুলিতে । যেগুলিতে গ্রে হাইড্রোজেন , ব্লু হাইড্রোজেন বা ব্রাউন হাইড্রোজেনের মতো হাইড্রোজেন ব্যবহার করলে পরিবেশের ক্ষতি হতেই থাকবে । সুতোরাং সবশেষে এককথায় বলা যায় , গ্রীণ হাইড্রোজেনই হল আমাদের অদূর ভবিষ্যৎ । তাই নিঃসন্দেহে আশা করা যায় ভারত সরকারের এই গ্রীণ হাইড্রোজেন নিয়ে দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুকেশ আম্বানি , গৌতম আদানীর মতো উদ্যোগপতিদের প্রচেষ্টার ফসল খুব শিঘ্রই দেশবাসী পেতে চলেছে । সেইসঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ‘জিও পলিটিক্যাল পাওয়ার ‘ – এর কারণে পুরো বিশ্ব আজ তাকিয়ে থাকে ভারতের আগামী দিনের পরিকল্পনা ও নীতির দিকে । তাই যদি সত্যিই নীতিন গডকড়ী মহাশয়ের কথামতো এরূপ কোনো অভূতপূর্ব ‘গ্রীন হাইড্রোজেন রিভোলিউশন ‘ ঘটে যায় ভারতে , তাহলে নিশ্চিতরূপে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে ভারত ।