২১ অক্টোবর ১৯৪৩। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা হলে সেদিন বিশাল সংখ্যায় হাজির ভারতীয়রা। ‘অন্তর্বর্তীকালীন স্বাধীন ভারত সরকার’ বা আজাদ হিন্দ সরকার গড়ার ঘোষণা করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। শপথ নিলেন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়ক রূপে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে রইল পররাষ্ট্র ও যুদ্ধ বিষয়ক দপ্তর। পূর্ণ মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্য ও উপদেষ্টা শপথ নিলেন। অর্থমন্ত্রী হলেন মেজর জেনারেল এসি চ্যাটার্জি, নারীবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন, প্রচার দপ্তরের দায়িত্বে রইলেন এস এ আইয়ার ও আইন বিভাগের দায়িত্বে এনএন সরকার। প্রবল হর্ষধ্বনিতে সভাস্থল মুখরিত তখন।

এই ঐতিহাসিক ও পরমগর্বের ২১শে অক্টোবরের প্রাক্ ইতিহাসটা না জানলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১৯৪১–এর ১৭ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসু গৃহত্যাগ করে গোমো, পেশোয়ার, কাবুল হয়ে ইতালির দূতাবাসের সহায়তায় ‘অকল্যান্ড মাৎসোটা’ ছদ্মনামে পাসপোর্ট নিয়ে রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে পৌঁছে গেলেন জার্মানি। বাড়ি থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির চোখে ধুলো দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে পাহাড়–পর্বত পায়ে হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাবুল। সঙ্গে একমাত্র সঙ্গী ভগৎরাম তলোয়ার।জার্মানিতে গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’।

কিন্তু উপলব্ধি করলেন, এত দূর থেকে সামরিক অভিযান সম্ভব নয়, তাঁকে যেতে হবে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া। কিন্তু এই প্রবল যুদ্ধের ঘনঘটার মধ্যে যাবেন কীভাবে দক্ষিণ এশিয়া? তখন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল সুভাষকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ জারি করেছেন।বিমানে যাওয়ার প্রস্তাব এলেও আপত্তি উঠল। একটি সাবমেরিনের ব্যবস্থা হল জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ জার্মানির কিয়েল বন্দর থেকে যাত্রা করেন তিন মাসেরও বেশি সময় সমুদ্রের তলা দিয়ে পেরিয়ে মাঝে ম্যাডাগাস্কার দ্বীপরাষ্ট্রের ৪০০ কিমি দূরে ‘পূর্ব নির্দিষ্ট’ স্থানে জার্মান ইউবোট থেকে জাপানের পাঠানো অন্য সাবমেরিনে চড়ে পৌঁছে গেলেন মালয়।

তারপর বিমানযোগে টোকিও পৌঁছলেন ১৬ মে সকালে। নেতাজির এই অনন্য সাধারণ কর্মকাণ্ডের কথা জেনে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সমগ্র ভারতীয় জনসাধারণ, যাঁরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছেন এই সাত–আটটি দেশে, তাঁরা নেতাজিকে কাছে পেতে তখন অধীর হয়ে উঠেছিলেন। উনি তখন আক্ষরিক অর্থেই রূপকথার রাজপুত্র, যিনি সবাইকে দেবেন তাঁদের মাতৃভূমি।টোকিও–তে তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বৃদ্ধ রাসবিহারী নেতাজিকে পূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি ও সংগঠনের অবস্থা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, এবার আমার দায়িত্ব শেষ, আমি মুক্ত।

২ জুলাই সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন নেতাজি সুভাষ এবং ৫ জুলাই আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈন্যদের সমাবেশে ভাষণ দিয়ে বললেন, ‘বর্তমানে আমি তোমাদের অন্য কিছুই দিতে পারি না— দিতে পারি শুধু ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কৃচ্ছ্রতা, ক্লেশপূর্ণ অভিযান অথবা হয়তো মৃত্যু। তবু যদি জীবনে–মরণে তোমরা আমায় অনুসরণ কর... আমি তোমাদের জয় ও মুক্তির পথে নিয়ে যাব’। এবার নেতাজি যেখানেই গেলেন, পেলেন এক অকল্পনীয় সমাদর ও আনুগত্য। ২৫ আগস্ট ১৯৪৩ আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বময় কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিলেন। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পূর্ণ মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্য ও উপদেষ্টা শপথ নিলেন , প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়ক রূপে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।